একদিন সন্ধ্যায় আমার এক কাজিন কৌতূহল ভরে আমাকে প্রশ্ন করলো—
👉 “ভাই, কম্পিউটার কি? আর কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের নাম কী কী, এগুলো আসলে কীভাবে কাজ করে?”
আমি হেসে তাকে বললাম—
“ভাব তো মানুষের শরীর যেমন মাথা, হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলে কাজ করে, তেমনি কম্পিউটারও একটি মেশিন হলেও অনেকগুলো অংশ একসাথে কাজ করে। প্রতিটি অংশের আলাদা আলাদা দায়িত্ব আছে। এই কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের নাম ও তাদের কাজের মাধ্যমেই পুরো কম্পিউটার সচল থাকে এবং আমরা পড়াশোনা, কাজ, গেমস বা ইন্টারনেট—সব কিছু করতে পারি।
এই প্রশ্নটা থেকেই আজকের এই ব্লগ পোস্ট — সহজ ভাষায় জানবো,
👉 কম্পিউটার কি,
👉 কম্পিউটার কী ধরনের যন্ত্র,
👉 এবং কম্পিউটার কি কি নিয়ে গঠিত।
🖥️ কম্পিউটার কি (Computer Ki)?
“কম্পিউটার” শব্দটা আমরা শুনে আসছি ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু কম্পিউটার আসলে কী?
কম্পিউটার হচ্ছে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র — যেটা মানুষের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণ করে এবং ফলাফল দেয়। সহজভাবে বললে, কম্পিউটার এমন একটি বুদ্ধিমান যন্ত্র, যেটাকে কমান্ড দেওয়ার সাথে সাথে সে নির্ভুলভাবে কাজ করে ফেলে — ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, প্রশ্ন নেই।

এটা যেমন টেক্সট লিখতে পারে, ভিডিও চালাতে পারে, আবার বিশাল বিশাল হিসাব-নিকাশও মুহূর্তে করে দিতে পারে।
কিন্তু এসব কাজ করতে পারে কীভাবে? তার জন্যই দরকার হয় অনেকগুলো যন্ত্রাংশ — যেগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা কাজ আছে।
🧩 কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের নাম ও কাজ
চলো, এবার একে একে চিনে নিই কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের নাম ও কাজ। ভাবো যেন একটা টিম — যেখানে প্রত্যেকে নিজেদের দায়িত্বে দক্ষ।
১. মাদারবোর্ড (Motherboard)
মনে করো এটা হচ্ছে কম্পিউটারের মূল প্ল্যাটফর্ম।
কম্পিউটারকে যদি একটি বাড়ির সাথে তুলনা করি, তাহলে মাদারবোর্ড হচ্ছে সেই বাড়ির ভিত্তি ও প্রধান রাস্তা। কারণ এখানে কম্পিউটারের সব অংশ একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে। CPU, RAM, হার্ডড্রাইভ, গ্রাফিক্স কার্ড—সবকিছুই মাদারবোর্ডের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে।

⚙️ মাদারবোর্ডের প্রধান কাজ
- কম্পোনেন্ট কানেক্ট করা: CPU, RAM, GPU, SSD/HDD, Power Supply সব এক জায়গায় সংযুক্ত হয়।
- ডেটা ট্রান্সফার: এক অংশ থেকে অন্য অংশে ডেটা স্থানান্তর করে।
- বিদ্যুৎ সরবরাহ: Power Supply থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে প্রতিটি অংশে সঠিকভাবে পাঠায়।
- Communication Control: হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে।
২. সিপিইউ (CPU – Central Processing Unit)
এটা কম্পিউটারের মস্তিষ্ক বা ব্রেইন।
কম্পিউটারকে যদি মানুষের শরীরের সাথে তুলনা করি, তাহলে CPU হচ্ছে মস্তিষ্ক। এর পূর্ণরূপ হলো Central Processing Unit। কম্পিউটারে যত কাজ হয়, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করে CPU।

⚙️ CPU-এর প্রধান অংশ
- ALU (Arithmetic Logic Unit): যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ও লজিক্যাল কাজ করে।
- CU (Control Unit): কোন কাজ কখন হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে।
- Registers: দ্রুতগতির ছোট মেমোরি, যেখানে অস্থায়ী ডেটা রাখা হয়।
৩. র্যাম (RAM – Random Access Memory)
RAM (Random Access Memory) হলো কম্পিউটারের অস্থায়ী মেমোরি। একে বলা হয় কম্পিউটারের “স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি”। আপনি যখন কম্পিউটারে কোনো প্রোগ্রাম চালান বা ফাইল ওপেন করেন, তখন সেটি সরাসরি হার্ডডিস্ক থেকে না পড়ে RAM-এ লোড হয়।

🖥️ RAM কীভাবে কাজ করে?
- ধরুন, আপনি Microsoft Word ওপেন করলেন। তখন সফটওয়্যারটি প্রথমে RAM-এ লোড হবে।
- যতক্ষণ আপনি ফাইলটি ব্যবহার করবেন, ততক্ষণ এটি RAM-এ থাকবে।
- কাজ শেষ করে ফাইল Save করলে সেটা হার্ডডিস্কে সংরক্ষিত হয়।
- কিন্তু কম্পিউটার বন্ধ করলেই RAM-এর সব ডেটা মুছে যায়।
৪. হার্ডড্রাইভ / এসএসডি (HDD / SSD)
কম্পিউটারকে যদি আমরা মানুষের মতো কল্পনা করি, তাহলে হার্ডড্রাইভ বা এসএসডি হচ্ছে স্মৃতিশক্তি (Memory Storage)। এখানে কম্পিউটারের সমস্ত ডেটা স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে—যেমন অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার, গান, ভিডিও, ছবি কিংবা আপনার অফিসের ডকুমেন্ট।

🖥️ HDD (Hard Disk Drive)
HDD হচ্ছে একটি প্রচলিত ডেটা স্টোরেজ ডিভাইস, যেখানে চুম্বকীয় ডিস্ক (Platter) ঘুরে ঘুরে ডেটা পড়া ও লেখা হয়।
- কাজের ধরণ: মেকানিক্যাল অংশ ব্যবহার করে।
- গতি: তুলনামূলক ধীর (5400 RPM / 7200 RPM)।
- স্টোরেজ ক্ষমতা: অনেক বেশি (১TB, ২TB, এমনকি ১০TB পর্যন্ত)।
- মূল্য: সস্তা।
- ব্যবহার: বড় ফাইল, ব্যাকআপ বা দীর্ঘমেয়াদে ডেটা রাখার জন্য উপযুক্ত।
⚡ SSD (Solid State Drive)
SSD হচ্ছে নতুন প্রজন্মের স্টোরেজ ডিভাইস, যেখানে কোনো মেকানিক্যাল অংশ নেই। সবকিছু সংরক্ষিত হয় মাইক্রোচিপে।
- কাজের ধরণ: ইলেকট্রনিক চিপে ডেটা সংরক্ষণ।
- গতি: অত্যন্ত দ্রুত (HDD থেকে ৫–১০ গুণ দ্রুত)।
- স্টোরেজ ক্ষমতা: সাধারণত ১২৮GB – ৪TB।
- মূল্য: HDD থেকে বেশি দামি।
- ব্যবহার: দ্রুত বুট, সফটওয়্যার লোডিং ও গেমিং-এর জন্য জনপ্রিয়।
👉 উদাহরণ: অনেকটা যেন একটি মেমোরি কার্ড বা পেনড্রাইভের মতো, তবে অনেক দ্রুত ও শক্তিশালী।
৫. পাওয়ার সাপ্লাই (Power Supply Unit – PSU)
এটা হলো কম্পিউটারের প্রাণশক্তি যোগানো ইউনিট।
কম্পিউটারকে যদি একটি বাড়ির মতো কল্পনা করি, তবে পাওয়ার সাপ্লাই (PSU) হলো সেই বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ। বিদ্যুৎ ছাড়া যেমন কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র কাজ করে না, তেমনি PSU ছাড়া কম্পিউটার এক সেকেন্ডও চালু হতে পারে না।

⚡ PSU কী করে?
- কম্পিউটার সাধারণত AC (Alternating Current) বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে বিদ্যুৎ নেয়।
- PSU সেই AC বিদ্যুৎকে রূপান্তর করে DC (Direct Current) তে, কারণ মাদারবোর্ড, CPU, GPU, HDD/SSD ইত্যাদি সব কম্পোনেন্ট DC বিদ্যুতে চলে।
- প্রতিটি অংশের জন্য আলাদা ভোল্টেজ সরবরাহ করে (যেমন 12V, 5V, 3.3V)।
👉 সহজভাবে: PSU বিদ্যুৎকে নিরাপদ, সঠিক ভোল্টেজে রূপান্তর করে প্রতিটি অংশে সরবরাহ করে।
৬. মনিটর (Monitor)
তোমার চোখ যা দেখে — সেটাই মনিটর।
কম্পিউটারকে যদি মানুষের শরীরের সাথে তুলনা করি, তবে মনিটর হচ্ছে চোখ। এর মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারে যা কিছু করি, তা দেখতে পাই। মনিটর ছাড়া কম্পিউটার কাজ করলেও ব্যবহারকারীর কাছে দৃশ্যমান হতো না।

🖥️ মনিটর কী?
মনিটর হলো একটি Output Device, যা কম্পিউটারের প্রসেস করা তথ্যকে ভিজ্যুয়াল আকারে প্রদর্শন করে।
- এতে টেক্সট, ছবি, ভিডিও, গেম সবকিছু স্ক্রিনে দেখা যায়।
- মনিটর সাধারণত CPU বা গ্রাফিক্স কার্ড থেকে সিগন্যাল নিয়ে ছবিতে রূপান্তর করে।
৭. কীবোর্ড ও মাউস (Keyboard & Mouse)
কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় আমরা প্রথমেই যেসব যন্ত্র হাতে নিই, তার মধ্যে অন্যতম হলো কীবোর্ড (Keyboard) এবং মাউস (Mouse)। এদের ছাড়া আধুনিক কম্পিউটার ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব।

⌨️ কীবোর্ড হচ্ছে এক ধরনের Input Device, যার মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারকে বিভিন্ন নির্দেশ বা ডেটা দিই।
- গঠন: সাধারণত ১০১–১০৫টি বাটন থাকে।
- ধরন:
- Mechanical Keyboard – টেকসই, গেমিং বা প্রফেশনাল কাজে বেশি ব্যবহৃত।
- Membrane Keyboard – সাধারণত লাইটওয়েট ও সস্তা।
- Wireless Keyboard – তার ছাড়াই ব্লুটুথ/ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়।
🖱️ মাউস হলো আরেকটি Pointing Input Device। এটি দিয়ে স্ক্রিনে কার্সর নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- ধরন:
- Wired Mouse – USB কেবলের মাধ্যমে সংযুক্ত।
- Wireless Mouse – ব্লুটুথ বা ওয়্যারলেস ডংগলের মাধ্যমে কাজ করে।
- Optical Mouse – LED লাইট দিয়ে কার্সর নিয়ন্ত্রণ।
- Gaming Mouse – অতিরিক্ত বাটন ও উচ্চ DPI সেন্সর যুক্ত।
৮. গ্রাফিক্স কার্ড (Graphics Card / GPU)
যদি তুমি গেম খেলো, ভিডিও এডিট করো বা 3D কাজ করো — তাহলে এর জন্য গ্রাফিক্স কার্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছাড়া কম্পিউটার ছবি, ভিডিও বা গেমকে সঠিকভাবে প্রদর্শন করতে পারে না।

🎨 গ্রাফিক্স কার্ড কী?
গ্রাফিক্স কার্ড বা GPU (Graphics Processing Unit) হলো এক ধরনের প্রসেসর, যা বিশেষভাবে ছবি, ভিডিও, অ্যানিমেশন ও 3D কনটেন্ট দ্রুত রেন্ডার করার জন্য তৈরি।
- CPU মূলত সাধারণ কাজ করে, আর GPU ছবি ও ভিজ্যুয়াল প্রসেসিংয়ে দক্ষ।
- মনিটরে যে ছবি বা ভিডিও দেখেন, সেটি আসলে GPU-র প্রসেস করা তথ্য।
📚 শেষ কথা: কম্পিউটার মানে শুধু মনিটর বা স্ক্রিন নয়!
আজকাল আমরা কম্পিউটার মানেই মনে করি শুধু মনিটর আর কীবোর্ড। কিন্তু এই লেখার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পেরেছন — একটি কার্যকর কম্পিউটার তৈরি হয় অনেকগুলো অংশ মিলে।
আপনি যদি জানতে চান “কম্পিউটার কি?” তাহলে অবশ্যই এর ভিতরের কাজগুলোর খোঁজ আপনার রাখতে হবে। কারণ বুঝেই শেখাটা আসল শিক্ষা — তাহলে শেখাটা হয়ে যাবে আপনার মজার বন্ধু।
